মার্কিন অর্থনীতির বিস্তৃতি, রাজনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে
ডিটেকটিভ আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এ দেশটিতে আয় বৈষম্যের পরিমাণ মার্কিন রাজনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।
অর্থনৈতিক মন্দার সময় পেরিয়ে রেকর্ড দশ বছর ধরে মার্কিন অর্থনীতি বিস্তৃত হলেও এ সময়জুড়ে ধনীদের সম্পদ যে হারে পাহাড় ছুঁয়েছে নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের সম্পদ সে তুলনায় তেমন বাড়েনি।
১২১ মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির দীর্ঘতম এ বিস্তৃতির মধ্যে অতি ধনীদের সঙ্গে বাকি সবার যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা আগে কখনোই এত বেশি ছিল না বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অতি ধনীদের পয়সা খরচের কিছু নমুনাও হাজির করেছে তারা।
বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড দল পিঙ্ক ফ্লয়েডের অন্যতম সদস্য ডেভিড গিলমোর গতমাসে তার সবগুলো গিটার ২ কোটি ১৫ লাখ ডলারে বিক্রি করে দেন।
এর মধ্যে কেবল ‘ব্ল্যাক স্ট্রাট’ ফেন্ডের স্টাটোকাস্টার গিটারটিই ৪০ লাখ ডলারে বিক্রি করেছেন। এটি কিনেছেন মার্কিন ন্যাশনাল ফুটবল লিগের দল ইন্ডিয়ানাপোলিস কোল্টের মালিক।
নিলামে বাদ্যযন্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে একে রেকর্ড বলছে রয়টার্স।
এর কয়েক সপ্তাহ আগে নিউ ইয়র্কভিত্তিক আর্ট ডিলার সথেবি’স হোল্ডিং নিলামে ক্লদ মোনের ‘মিউলস’ চিত্রকর্মটি বিক্রি করে ১১ কোটি ৭ লাখ ডলারে। ইম্প্রেশনিস্ট ঘরানার কোনো চিত্রকর্মের ক্ষেত্রেও এটিই সর্বোচ্চ দাম।
কেবল বাদ্যযন্ত্র বা চিত্রকর্মের দিকেই নয়; অতি ধনীদের কারও কারও চোখ এমনকি নিলাম প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকেও আছে।
গিলমোরের গিটারের নিলামের কয়েকদিন আগেই ফরাসী-ইসরায়েলি ধনী প্যাট্রিক দ্রাহি নিলাম প্রতিষ্ঠান সথেবি’সকে কিনতে ৩৭০ কোটি ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন অর্থনীতির এ বিস্তৃতিতে সময় যত গড়িয়েছে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতিকরণ, প্রাসাদোপম বাড়ি, স্পোর্টস দল, ইয়টসহ বিলাসী দ্রব্যের দামও তত বেড়েছে।
বড় বড় অংকের এসব বেচাকেনার খবর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার পাশাপাশি ট্রেন্ডেও পরিণত হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
তাদের হিসাব মতে, ২০০৮ সালে মার্কিন বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল ২৬৭; গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০৭ জনে।
“ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, দ্রুতগতিতে হচ্ছে। ভোগের প্রবণতার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে,” বলেছেন ইউবিএসের প্রাইভেট ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড আল্ট্রা হাই নেট ওর্থের প্রধান জন ম্যাথিউস।
ধনীরা আরও ধনী হলেও স্বল্প আয়ের মানুষকে সংগ্রামের মাত্রা বাড়াতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচ ধনী এখন দেশটির মোট সম্পদের ৮৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থনৈতিক মন্দার আগে থেকেই সম্পদের বেশিরভাগই অল্পকিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার এ প্রবণতা বাড়ছিল বলে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের তথ্যে দেখা গেছে।
আবার একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফুড স্টাম্প’ প্রকল্পে হাত পাতা মানুষের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯০ লাখে; যা ২০১৩ সালের তুলনায় কম হলেও ২০০৮ সালের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
স্বল্প আয় ও নিম্নবিত্তের মানুষকে তাদের আয় অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার সরবরাহে মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকার এ ‘ফুড স্টাম্প’ প্রকল্প চালায়।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে বাসিন্দাদের গড় বেতন যে পরিমাণ বেড়েছে বাসাভাড়া তার চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্ট্রিটইজি।
অন্যদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুমানো উদ্বাস্তুর সংখ্যা এক দশক আগের তুলনায় বেড়েছে ৭০ শতাংশ, বলেছে উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কোয়ালিশন ফর দ্য হোমলেস।
স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়েছে, কমেছে চাকরি। খাবার, বাড়ি ও অন্যান্য সেবার খরচেও আক্রা। যে কারণে মার্কিন অর্থনীতির বিস্তার সবার কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন সেন্ট্রাল বার্কশায়ার হেবিট্যাট ফর হিউম্যানিটির প্রধান নির্বাহী ক্যারোলিন ভ্যালি।
স্বল্প আয়ের মানুষের হাতে এক দশক আগের তুলনায় খানিকটা বেশি পয়সা এলেও তাকে ক্ষণস্থায়ী বলছেন পর্যবেক্ষকরা। নতুন কোনো মন্দা এলে মাত্রই শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করা মানুষেরাই বিপাকে পড়বেন বলেও আশঙ্কা তাদের।
রয়টার্স বলছে, এক দশক আগেও এ ধরনের প্রবৃদ্ধির কথা কল্পনাও করা যেত না। সে সময় মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এমন বিশৃঙ্খলা ছিল যে সাধারণ মানুষ ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় পুঁজিবাদ চিরতরে ধ্বসে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিল।
মার্কিন গৃহায়ন খাতে অস্থিরতার পাশাপাশি বাজার স্থিতিশীল ও সম্পদের দাম নিয়ে নীতিনির্ধারকরা হিমশিম খাচ্ছিলেন। নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয়ে মাথা ঘামালেও তারা আয় ও সম্পদ বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে তেমন কিছুই করেননি।
এসব কারণে এখন ধনীদের সঙ্গে অন্যান্যের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা নতুন আরেকটি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেও আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।